যে বার সৌদি আরব গেলাম

অন্যান্য
Spread the love
২য়—- পর্ব
★ রিয়াদে পৌঁছুলাম★
এখন আর মনে নেই। দেড় কি দু’ঘন্টার পথ। মসৃন ঝা চক চকে রাস্তা। এতটুকু ঝাঁকিও অনুভূত হচ্ছে না। প্রশস্ত রাস্তার দু’পাশে বিশাল সব বিলবোর্ডে এ্যাড। তবে অযথা নারীর ছবি বিবর্জিত। ফোর্ড গাড়িতে করে আমরা চলেছি এয়ারপোর্ট থেকে রিয়াদের উদ্দেশ্যে। আমেরিকার তৈরি এই গাড়ি সৌদি আরবে বহুল ব্যবহৃত গাড়ি। আমাদের জন্য এই সর্বত্র এই গাড়িই নির্ধারিত ছিল। আমি অবশ্য প্রথম দেখলাম এই গাড়ি। যথেষ্ট প্রশস্ত এই গাড়ি আমাদের দু’ জনের জন্য । ডিজি ও ওনার মিসেসের জন্য আরেকটি ফোর্ড গাড়ি নির্ধারিত। রাস্তায় আরো চলছে মার্সিডিজ বেঞ্জ। অর্থাৎ জাপানি টয়োটার এখানে তেমন গুরুত্ব নেই।
সৌদি ড্রাইভার ভাষা বোঝে না। তদুপরি সম্ভবত সেনাবাহিনীরই হবে। তাই তারা কথা বলবেও না। নইলে ড্রাইভার বা গাইডরাই খোঁজ খবরের ভাল মাধ্যম। অতএব চুপচাপ রাস্তা দেখছি। প্রচুর আলো আর খেজুর গাছের সারি। আইল্যান্ডেও খেজুর গাছ। কখনও আলোকসজ্জিত তবে গাছগুলো বেঁটে আকৃতির। আমাদের দেশের খেজুর গাছের তুলনায় অনেক ছোট সাইজ। কিন্তু থোকা থোকা খেজুর ধরে আছে। অন্য কোন গাছ নেই বললেই চলে। একসময় পৌঁছুলাম হোটেলের পোর্টিকোতে।
মেইন রোডের উপর পাঁচ তারকা বিলাসবহুল হোটেল। সেখানে অনেক সৌদি ও বাংলাদেশী অনেকে অপেক্ষমান। ডিজির সাথে দেখা করার জন্য অনেকে এসেছেন। ডিজি ভাই যেমন মিশুক তেমনি সদালাপী। তাই তাঁরা ভক্তের অভাব নেই। আর এদেশে আগেও এসেছেন তিনি একাধিক বার। তাঁর আত্নীয় স্বজনও আছেন। ফলে লোকজনের অভাব নেই। যারা এসেছেন তাঁদের সাথে কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে গেল। ওখানে খেয়াল করে দেখলাম কিছু সৌদি অফিসার রয়েছেন ইউনিফর্মে। অর্থাৎ ডিউটিতে। কিন্তু কেউ যেচে কথা বলছে না। সবার মুখেই দাঁড়ি। একজন ক্যাপ্টেন সাহেব তো গ্রীক ভাস্কর্যের মত দেখতে। দাঁড়িও তাকে চমৎকার মানাচ্ছে। তবে নিঃশব্দ রোবটের মত। ওদের দাঁড়িরও একটা সৌন্দর্য আছে। কাউকে বেমানান লাগছে না। আর সুবিন্যস্তও, বিপর্যস্ত নয় এমন। শিখ পুরুষদেরকেও যেমন দাঁড়িতেই মানায়।
রাত গভীর হচ্ছে। সাড়ে বারটার দিকে সবাই বিদায় নিলে আমরা আমাদের নির্ধারিত স্যুটে পৌঁছুলাম। পৌঁছে দেখি সুসজ্জিত রুমে বিশাল বিশাল ফ্রুট ডিসে কয়েক পদের খেজুর, ডুমুর, আঙুর, আপেল, নাশপাতি, মসৃণ সুদৃশ্য কলা আর বিভিন্ন ধরনের বাদাম সাজিয়ে রাখা। স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে শুভ্র নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেল।
কিছু পরেই সে ডাকছে, ” খাবে এসো। ডিজি স্যার বসে আছেন।” সচরাচর আমি ক্লান্ত হই না। অথচ জার্নির ধকলে বিদ্ধস্ত আমি বললাম, “আমাকে মাফ করা যায় না।” সে বলল, “সিনিয়র অপেক্ষা করছেন। আর দেরী করা যাবে না। ওহ! ঘুমেরও স্বাধীনতা নেই বাবা। অথচ আমি জানি এই ঘুম ভেঙে গেলে আমাকে হয়ত সারারাত জাগতে হবে।
আমি ইনসমনিয়ার রোগী।
উপায় তো নেই। এখানে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। ডিজির স্যুটে গিয়ে দেখি বড়সড় একটা ডাইনিং টেবিলে বিশাল খাবারের আয়োজন। ভাত আর মাংসের মিশ্রনে তৈরি বিরিয়ানী টাইপের একটা ডিস। পাত্রটা এত বড় যে তাতে একটা বড় খাসির রোস্ট ধরে যায়। রকমারি আরো খাবার দাবার রুমেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
—–কি আর করা পড়েছি যবনের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে। বসলাম কিন্তু ঘুম আর ক্লান্তিতে আমি যেন ঘোরের মধ্যে খাচ্ছি। আইটেমের কোন শেষ নেই। ফল আর মিষ্টান্নে ভরপুর। ওদের সিস্টেম হল একটা বিশাল ডিশ থেকে হাত দিয়ে তুলে তুলে খাওয়া। কিন্তু আমাদের সামনে নিজ নিজ প্লেট রাখা।
স্মৃতি থেকে লিখতে গিয়ে এতদিন পর একটু সমস্যা হচ্ছে। অনেক কিছুই বাদ পড়ে যাচ্ছে। মনে হল বেশ ক’জন ওয়েটার ফুড সার্ভ করার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। ওরা কি আমাদের খাইয়ে মারার প্লান করেছে! ভাবছি ৬ জন লোককে খাবার সার্ভ করার জন্য মধ্যরাতে এত ওয়েটার কেন! পরে বুঝলাম ওরা বাংলাদেশী। কে কিভাবে আপ্যায়ন করবে তাতেই ব্যাকুল। এর আরো একটি কারণ তারা তাদের সৌদি আরবের থাকার অসুবিধাগুলো ডিজিকে জানাতে চায়। ঘুমের ঘোরে শুনছি তাদের নানান অভিযোগের কথা।
পরদিন অনেকগুলো ভিজিট ছিল। পুরুষদের জন্য সেনানিবাস সংক্রান্ত। সেটিতে তাদের সকালের নাস্তার পরই নেওয়া হল। আর সবার জন্য কতগুলো ভিজিট ছিল। গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিজিট ছিল কিং ফাহাদ কমপ্লেক্সে। সেখানে পৌঁছে দেখি সুরম্য অট্টালিকা। চার পাশে দৃষ্টি নন্দন বাগানবিলাস ফুটে আছে। পাথুরে পাহাড় আর রুক্ষতার ভেতর একপশলা বৃষ্টির মত। ভারি ভাল লাগলো। ওখানে খুব সমাদরে আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। এখানেই মুলত কোরআন প্রিন্ট করা হয়। যিনি আমাদের আপ্যায়ন করে ভেতরে নিলেন তিনি দীর্ঘদেহী ঋজু শরীরের একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি। সফেদ দাঁড়ির আলখেল্লা পরা একজন অত্যন্ত সুদর্শন চেহারার মানুষ। প্রথমে আমাদের আপ্যায়ন করা হল ড্রিংকস আর নাস্তা সহযোগে।
এরপর তিনি আমাদের অনুসরণ করতে বললেন তাঁকে। সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আমরা সিঁড়ি ভেঙে উপরে সেখানে গেলাম। দেখলাম যে সেটা মূলতঃ কোরআন প্রিন্টং প্রেস। সুবিশাল এবং উচ্চতা সম্পন্ন একটি ঘরে দু’টি সেকশন। একই রুমের একপাশে দোতালায় দাঁড়িয়ে রেলিং ধরে দেখছি প্রিন্টিংএর কাজ। নীচে বিরাট একটা রেহেলের উপর রাখা আছে বিশালকায় এক কোরআন শরীফ। এর বিশালত্ব বোঝাতে পারব না মুখে বলে। ঐ নুরানি চেহারার মানুষটি অনেক কিছু বুঝিয়ে বলছেন চোস্ত ইংরেজিতে। কিন্তু বিস্মিত আমি সব কথা ধারণ করতে পারছি না। শুধু এটুকু মনে আছে তিনি বলেছিলেন, একটি কোরআন পাবলিশ করার আগে প্রতিটি কোরআন বার বার চেক করা হয় যাতে কোন ভুল না হয়। কোরআনের বিশুদ্ধতাই তার বৈশিষ্ঠ্য। একটি চিহ্নও ভুল প্রিন্ট হলে সেই কোরআন বাতিল করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি আমাদের সেখান থেকে সুদৃশ্য দু’টি করে কোরআন ও আরো কিছু গিফট প্রদান করেন। সেগুলো নিয়ে আমরা বিদায় নেই।
আসার সময় আমি ভাবতে থাকি আমাদের মহানবী না জানি আরো কত সুদর্শন ছিলেন। কে জানে? এদেশের নারীরাও খুব সুন্দর!!
(চলবে)