প্রতাপশালী ‘কিংস পার্টি’ এখন বিলীনের পথে

রাজনীতি
Spread the love

প্রতাপশালী ‘কিংস পার্টি’ এখন বিলীনের পথে। ‘ওয়ান-ইলেভেন’র (২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি) পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়।

আর যেসব জেলায় কাঠামো আছে, সেখানে নেই দফতর। আবার কোথাও দফতর থাকলেও নেই কোনো সাইনবোর্ড। তবে ওই সময় প্রকাশ্যে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে নানা বক্তব্য দিলেও এখন ওইসব দলের নেতাদের দাবি- তারা কেউ কিংস পার্টিভুক্ত ছিলেন না।

‘ওয়ান ইলেভেনের’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যেসব দল কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পায় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বিএনপির সাবেক নেতা ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী ফারুক আহম্মদের ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি।

এছাড়া সে সময় নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সামনে রেখে কিংস পার্টির মূল নেতৃত্ব দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ লক্ষ্যে তাকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করার নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরুও হয়। তবে শেষ মুহূর্তে ড. ইউনূস এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন। আর শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাগপাসহ পুরনো আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও ১১ জানুয়ারির পর তাদের বেশকিছু সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের কারণে কিংস পার্টি হিসেবে খ্যাতি পায়।

কিংস পার্টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, আগেরকার আমলে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে তাদের সমর্থকদের নিয়ে যে প্লাটফর্ম গঠন করা হতো তাকেই কিংস পার্টি বলা হতো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমমনা উপদলগুলোকে একত্রিত করে (একই মতাদর্শে বিশ্বাসী) দল গঠনের প্রক্রিয়াকেই কিংস পার্টি বলা যেতে পারে। এটা শুরু হয় আইয়ুব খানের পাকিস্তান আমলে।

তিনি বলেন, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে তা সফল হয়নি। ইতিহাস বলে কিংস পার্টির উদ্যোগ সব সময়ই ব্যর্থ হয়েছে। ‘ওয়ান-ইলেভেন’র সময় কিংস পার্টির মধ্যে শুধু কল্যাণ পার্টি বাদে সব দল এখন হারিয়ে গেছে। কারণ রাজনৈতিক দল তৈরি হয় জনসাধারণের প্রয়োজনে, রাজনৈতিক নেতাদের প্রয়োজনে।

২০০৭ সালের ২১ জুন বিএনপির সাবেক নেতা ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল-পিডিপি গঠন করা হয়। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একটি বড় অংশকে এ দলে টেনে আনা সম্ভব হবে। কিছুদিন এ ধরনের প্রচারণা চললেও শেষ পর্যন্ত বড় দলের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা যোগ দেননি এই নতুন দলে।

এ প্রসঙ্গে পিডিপির মহাসচিব প্রিন্সিপাল এমএ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘ড. কোরেশীর সঙ্গে তৎকালীন সরকারের বনিবনা হয়নি। ওনারা (তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংশ্লিষ্টরা) চেয়েছিলেন ক্ষমতায় থেকে দল করার জন্য। ওনি (কোরেশী) বলেছেন না, আমার দলের মাধ্যমেই আপনারা যদি আসেন তাহলে সেভাবে কাজ করব। এগুলো নিয়ে বিরোধ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আর হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তখন কিংস পার্টির নামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সব বড় বড় নেতা আমাদের সঙ্গে চলে এসেছিল।

তাদের একটা চিন্তাভাবনা ছিল ড. কোরেশীর নতুন দল ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুই নেত্রী যখন বেরিয়ে এলেন আবার সবাই নিজ নিজ দলে ফিরে গেলেন। সেজন্য দলে আবার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এখন পিডিপি হল একটা নিবন্ধিত দল। এটাকে তো ফেলে দিতে পারি না, তাই ধরে রেখেছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিডিপির এখন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে মাত্র ১৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে দলটি। যেখানে আবার শীর্ষ নেতারা কেউ নির্বাচনে অংশ নেননি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ছাড়া আর কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়নি পিডিপি। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকার বাইরে ১০-১২ জেলায় কার্যালয় আছে তাদের। বেশির ভাগ জেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাসভবনই মূলত কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এছাড়া দলের চেয়ারম্যান ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী কয়েক বছর ধরে অসুস্থ। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এহসানুল হক সেলিমের নেতৃত্বে একটি অংশ কাউন্সিল করে ড. কোরেশীকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেন। যেখানে সভাপতি করা হয় দেলোয়ার হোসেনকে ও মহাসচিব এহসানুল হক সেলিমকে।

পরে তলবি সভা ডেকে ড. কোরেশী তাদের বহিষ্কার করে নতুন কমিটি করে তিনিও তা নির্বাচন কমিশনে জমা দেন। এ নিয়ে পরে মামলা পর্যন্ত হয়। নির্বাচন কমিশন ড. কোরেশীর পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন এহসানুল হক সেলিম, যা এখনও চলছে। পিডিপি মহাসচিব এমএ হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আমাদের নামে প্রতীক রয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও আমাদের প্রতীকে ১৪ আসনে নির্বাচনও করেছি।

২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বে কল্যাণ পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। তবে এই দলটি এখন মূলধারার রাজনীতিতে ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক কল্যাণ পার্টি। সম্প্রতি এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নতুন জোট জাতীয় মুক্তমঞ্চে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের আলোচনায় এসেছে দলটি। বর্তমানে ৩০ জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে কল্যাণ পার্টির, আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে ৮ জেলায়।

কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রীয় সরকারের আর্থিক এবং প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধার ওপর ভর করে সাময়িকভাবে যিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যে দলগুলোকেই কিংস পার্টি বলা হয়। সে দলগুলোর অস্তিত্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে খুব বেশি থাকে না। অতএব ওটা বলার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

কারণ অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক কোনো সহযোগিতাই আমরা মঈন ইউ আহমেদের (তৎকালীন সেনাপ্রধান) কাছ থেকে নেইনি। অতএব ওই বিষয়ে কোনো মন্তব্যই আমি করতে রাজি না।

২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী ফারুক আহম্মদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন। দল প্রতিষ্ঠার আগেই কাজী ফারুক রাজনীতিতে বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছিলেন। সে সময় রাজধানীতে বেশ বড় বড় একাধিক সমাবেশ করেছিলেন। ২০০৮ সালের ১৬ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পায় দলটি।

২০০৯ সালের ২৪ মে কাজী ফারুককে প্রশিকার চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করার পর থেকে দলটির কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নিবন্ধন আইনের শর্ত পূরণ করতে না পারায় প্রশিকার সাবেক চেয়ারম্যান কাজী ফারুকের এই দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়।

ওই সময় তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘তাদের সারা দেশে কোনো অফিস আমরা পাইনি। সময় দেয়ার পরও তারা তাদের তথ্য দেয়নি। তারা শর্ত পূরণ করেননি এবং তাদের কাছ থেকে আমরা যে প্রতিবেদন চেয়েছিলাম তা দাখিল করেন নাই।’ আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন পেতে এক-তৃতীয়াংশ জেলা ও ১০০টি উপজেলায় কমিটি অথবা থানায় কার্যালয় থাকতে হয়।

২০০৭ সালের ১৯ জুলাই শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আত্মপ্রকাশ ঘটে। তখন দলটির মহাসচিব ছিলেন ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। সে সময় এ দলের নেতারা অনেক দাপুটে ছিলেন। এ মুহূর্তে দলটির নেতারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ২০১৩ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ১৮ দলীয় জোটে যোগ দেন। ২০১৫ সালে নীলু বিএনপি জোট থেকে বের হলে ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে একটি অংশ জোটে থেকে যায়। শেখ শওকত হোসেন নীলুর মৃত্যুর পর এখন তার ছোট ভাই শেখ ছালাউদ্দিন ছালু মূল অংশের (নিবন্ধিত) চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই মণ্ডল।

এনপিপির চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা দল গঠন করেই প্রকাশ্যে বলেছি খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, তারেক রহমানসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দিতে হবে। আমরা যদি কিংস পার্টি হতাম তাহলে তাদের কথা বলতাম না। আমরা বলেছি গণতন্ত্র দিতে হবে, নির্বাচন দিতে হবে। এসব দাবির পক্ষে সে সময় আমরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারও করেছিলাম।

আরেক অংশের চেয়ারম্যান শেখ ছালাউদ্দিন ছালু বলেন, আমরা আট দলের সমন্বয়ে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে রয়েছি। আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুরানা পল্টনে। এছাড়া আমাদের ৩৫টি জেলায় কার্যালয় আছে। কমিটি আছে ৫৮টি জেলায়।