করোনার ‘তাণ্ডবলীলা’ কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে অনুমান করতে পারছে না কেউ

অন্যান্য
Spread the love

করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। রোজ হাজার হাজার মৃত্যু ও অজস্র মানুষের আক্রান্তের খবর আসছে।  হাসপাতালগুলোও রোগীদের চাপ নিতে পারছে না।  বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনও মৃত্যুঝুঁকিতে। 

এরপরও করোনার ‘তাণ্ডবলীলা’ থেমে নেই।  কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে সেটিও কেউ অনুমান করতে পারছে না।

এমতাবস্থায় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে অতিসংক্রামক কোভিড-১৯ প্রতিরোধে নির্ভরযোগ্য টিকার।  করোনায় প্রাণহানি ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে কার্যকর প্রতিষেধকের বিকল্প নেই।

পৃথিবীতে চলমান চিকিৎসা ব্যবস্থা যে মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর নয় সেটি আবারও আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল করোনা।

বৈশ্বিক এই মহাসংকট থেকে বেরিয়ে আসতে ভ্যাকসিনের পাশাপাশি গোটা বিশ্বে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি সবচেয়ে ভালো বিকল্প বলে মনে করা হচ্ছে।

এই মহামারীর আগে সার্স ও মার্সের টিকা উদ্ভাবনের কাজ হয়েছে। এগুলো করোনা প্রতিরোধের টিকা উদ্ভাবন সহজ করে দিয়েছে।  ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ৫৭টি টিকা ক্লিনিক্যাল রিসার্চ বা রোগীভিত্তিক গবেষণায় ছিল।

যার মধ্যে ৪০টি প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের এবং ১৭টি দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় ছিল।  এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ৯৫ শতাংশ ফলপ্রসূ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে ট্রায়ালে।  ট্রায়ালের ফল দেখে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবিত টিকা ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।  এর ভিত্তিকে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ করোনার টিকার ব্যবহার শুরু করেছে।

রাশিয়া, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ব্রাজিল, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশ করোনার টিকা দেয়া শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ মানুষকে করোনার টিকা দেয়া হয়েছে।

ডিসেম্বর নাগাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০০ কোটি টিকার প্রাক-আদেশ দেয়া হয়েছে, যার অর্ধেক ক্রয়াদেশ এসেছে উচ্চ-আয়ের দেশগুলো থেকে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ।

ফাইজার-বায়ো এনটেক, মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা/অক্সফোর্ড– তিনটি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ২০২১ সাল নাগাদ ৫৩০ কোটি টিকা বিতরণের পূর্বাভাস দিয়েছে।  তবে বৈশ্বিক চাহিদার কারণে ২০২৩ বা ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্বল্পআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা সহজলভ্য হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।

এসব অনিশ্চয়তার পরও বিশ্ববাসীকে দুদণ্ড স্বস্তি এনে দিয়েছে টিকা উদ্ভাবনের খবর।  বিপর্যস্ত মানুষগুলো বছর শেষে সুরঙ্গের শেষে ঝলমলে আলো দেখছে এই উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে।

এর আগে এত কম সময়ের মধ্যে কোনো সংক্রামক রোগের টিকা উদ্ভাবন হয়নি।  ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিনে উহানে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর গত জানুয়ারিতে ভাইরাসটির জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশ পেয়েছে। এতে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জরুরি আন্তর্জাতিক প্রস্তুতি ও প্রতিষেধক আবিষ্কার ত্বরান্বিত করেছে।

ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, অন্তত ১৮ মাসের আগে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপাইরেটরি সিন্ড্রোম করোনাভাইরাস-২ রোগের টিকা উদ্ভাবনের কথা তারা ভাবতে পারছেন না। কিন্তু বছরের শুরুতে বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নিয়ে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এতে টিকা উদ্ভাবনের প্রতিও জোর দিতে থাকে দেশগুলো।

গত মার্চে চারটি টিকা মানব শরীরে পরীক্ষা করা হয়। এপ্রিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিভিন্ন প্রযুক্তিতে তিনটি বা তার বেশিসংখ্যক টিকা উদ্ভাবন ও বিতরণে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের দরকার পড়বে। এ মাসেই ১৯ দেশের ৮০টি কোম্পানি ও ইন্সটিটিউট দ্রুতগতিতে কাজ শুরু করার কথা জানায়।

জুলাইয়ে অ্যাংলো-আমেরিকান গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো, সশস্ত্র বাহিনী, ব্রিটেনের জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কেন্দ্র, কানাডীয় যোগাযোগ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান, যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সাইবার সিকিউরিটি অবকাঠামো নিরাপত্তা সংস্থা ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) অভিযোগ করেছে, অন্যান্য দেশের ওষুধ কোম্পানি থেকে রাশিয়া-সমর্থিত হ্যাকাররা কোভিড-১৯ চিকিৎসা ও টিকা সম্পর্কিত গবেষণা তথ্য চুরি করার চেষ্টা করছে।

যদিও রাশিয়া সেই তথ্য অস্বীকার করেছে।  এপ্রিলে কয়েক ডজন টিকা বিজ্ঞানীর প্রতিনিধিত্বে একটি বিবৃতি ইস্যু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবন জোরদারে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতায় উৎসাহিত করে ডব্লিউএইচও।

অতীতের টিকা উদ্ভাবনের শিল্প বিশ্লেষণে ৮৪ থেকে ৯০ শতাংশ ব্যর্থতার দৃশ্য দেখা গেছে। তাড়াহুড়ো ও দ্রুততার সঙ্গে টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টায় ঝুঁকি বাড়া ও ফলপ্রসূ কম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন গত ১১ ডিসেম্বর জরুরিভিত্তিতে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এটাকে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরীক্ষার প্রক্রিয়ার পরবর্তী স্তরে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ফল পাওয়া গেছে ফাইজারের টিকায়।

এর আগে ব্রিটেনেও এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমতি মিলেছে। দেশটি চার কোটি ডোজ দেয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।

এ ছাড়া ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজভিত্তিক জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি মডার্নার টিকারও অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ টিকার কার্যকারিতা ৯৪.১ শতাংশ বলে দেখা গেছে। ফাইজার ও মডার্নার টিকার মধ্যে অনেক মিল থাকলেও ফারাকও আছে। মডার্নার টিকা একটু বেশি নমনীয়। দুই টিকার কার্যকারিতাও কাছাকাছি পর্যায়ের।

মডার্নার টিকা ১৮ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের লোকজনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।  আর ফাইজারের টিকা ১৬ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সীদের শরীরে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

ফাইজারের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে, ইনজেকশনের স্থলে কয়েক দিন ব্যথা অনুভব করা। এছাড়া ক্লান্তি চলে আসে, মাথা ও পেশিতে ব্যথা, সর্দি-কাঁপুনি, শরীরে সংযোগস্থলে ব্যথা ও জ্বর হতে পারে।

মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোমসহ মডার্নার টিকারও মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। টিকা গ্রহণের পর ব্যাপক অ্যালার্জি সমস্যার কথা জানিয়েছেন বোস্টনের এক চিকিৎসক। এ ছাড়া মাথা ঝিমঝিম করা ও হৃদকম্পন বেড়ে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।

তবে করোনার নতুন যে ধরন পাওয়া গেছে, সেটি প্রতিরোধেও মডার্নার টিকা কার্যকর বলে কোম্পানিটি জানিয়েছে। আশ্বাস দিয়ে বলছে, এ ক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর বায়োএনটেকের প্রধান নির্বাহী উঘুর শাহিন বলেন, ছয় সপ্তাহের মধ্যে করোনার নতুন ধরনের টিকা উদ্ভাবন সম্ভব হবে।

এছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়/অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও পরীক্ষার পর্যায়ে আছে। এটি বয়স্ক লোকদের শরীরে জোরালো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পেরেছে বলে উপাত্তে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ব্রিটেনে টিকাটির ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

বিশ্বে সর্বপ্রথম টিকার অনুমোদন দিয়েছে রাশিয়া। দেশটির স্পুটনিক ভি টিকা অক্সফোর্ডের মতোই কাজ করে, যার কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ বলে দেখা গেছে।

জ্যানসেনসের টিকার পরীক্ষার জন্য ব্রিটেনে ছয় হাজার ও বিশ্বজুড়ে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে বাছাই করা হয়েছে। উহান ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস ও সিনোফার্মের টিকার পরীক্ষাও চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।

করোনায় প্রাণহানি ও আক্রান্তের সবশেষ পরিসংখ্যান রাখা আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারসের সবশেষ তথ্যানুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত মহামারীতে ৮ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৩১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

আর মৃত্যু হয়েছে ১৮ লাখ ১২ হাজার ১০৮ জনের।  এই পরিসংখ্যান করোনার প্রতিশেধকের ওপর বিশ্ববাসী কতটা নির্ভরশীল সেটিরই প্রমাণ দেয়।