একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এই বিপুল জয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের কাঁধে বড় দায়িত্বও অর্পিত হয়েছে। দেশের জনগণ বিশেষ করে তরুণ সমাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি অগাধ আস্থা ও বিপুল প্রত্যাশা রেখে অভূতপূর্ব রায় দিয়েছে। তারা আশা করেন, নতুন সরকার তাদের প্রত্যাশা পূরণে অবিচল থাকবে।
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা দেশের মানুষকে আরও বেশি আস্থাশীল করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি। ওই ইশতেহারে বিশেষ করে গ্রামগুলোতে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া, তরুণদের কর্মসংস্থান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, তা সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় উজ্জ্বল আগামীর স্বপ্নে ভাসিয়েছে সাধারণ মানুষকে।
বিশিষ্ট নাগরিকরা মনে করছেন, ইশতেহারে এই প্রতিশ্রুতিগুলো সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করেছে। এখন নতুন সরকারের সামনে দেশের মানুষের সেই বিপুল প্রত্যাশা পূরণই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করছেন, মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার পাশাপাশি নিরঙ্কুশ সংসদে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জও নতুন সরকারকেই নিতে হবে।
বিশ্নেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনের ফল প্রমাণ করেছে- বিগত দশ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যে উন্নয়ন এবং অগ্রগতির ধারায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, তার ফলে দেশের মানুষের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আগে থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার জরিপে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনে জয়ী হবেন। ভোটের ফলাফল তার যথার্থতা প্রমাণ করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ইস্পাতকঠিন সাহসী নেতৃত্বের কারণেই তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। দেশের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক নৌকার পক্ষে আরও একবার মাইলফলক রায় দিয়েছে জনগণ।
বিশ্নেষকদের মতে, নিরঙ্কুশ এই বিজয় বিশাল দায়িত্বও এনে দিয়েছে সরকারের সামনে। বিপুল ভোটের মাধ্যমে জনগণ যে আমানত নতুন সরকারের হাতে তুলে দিল, তার সঠিক প্রয়োগ যেন হয়। সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে সরকার পরিচালনায় সংশ্নিষ্ট সবাইকে। এ কারণে প্রতিটি পদক্ষেপে দায়িত্বশীল ভূমিকাই হবে প্রত্যাশিত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে তার দৃষ্টিতে তিনটি বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সুশাসনকে শক্তিশালী করা, দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ এবং তৃতীয়ত, উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য দূর করা। তিনি বলেন, সুশাসন নিয়ে সরকারের গত মেয়াদে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। গুম, হয়রানিমূলক মামলা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বাড়াবাড়ির বিষয়টি নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন উঠেছে। প্রত্যাশা থাকবে, এই মেয়াদে এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না এবং সুশাসন আরও শক্তিশালী হবে। একই সঙ্গে নাগরিকদের কয়েকটি বিষয়ে প্রত্যাশা আছে- সড়ক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং মাদকমুক্ত সমাজ। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে বড় অভিযান পরিচালনা করেছে, কিন্তু রাঘববোয়ালদের অনেকেই ধরা পড়েনি। এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। সড়কে গণপরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এসব ক্ষেত্রে নতুন সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূর করার প্রসঙ্গ তুলে ধরে রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, অর্থনীতিবিদদের বিশ্নেষণ অনুযায়ী উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গে গ্রাম ও শহরের মধ্যে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। এ কারণে সম্পদের সুষম বণ্টনও হবে নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। বাল্যবিয়ে এবং নারী নির্যাতন আরও কমিয়ে আনার দায়িত্বও নতুন সরকারকে নিতে হবে বলে তার অভিমত।
এবার মহাজোটের পক্ষে গণরায় এতটাই বেশি যে, একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কার্যত অস্তিত্ববিহীন থাকতে পারে- এ প্রসঙ্গ টেনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুব্যবস্থাপনা, বিশেষত জবাবদিহি নিশ্চিত করাই হবে নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বড় জয়ের ক্ষেত্রে ক্ষমতা আরও বেশি কেন্দ্রীভূত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সেটা যেন না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, সরকারের জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই উন্নয়নের সুফল সমানুপাতিক হারে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এটাও নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নির্বাচনী ইশতেহারের এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা বড় কঠিন হবে- এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতিমুক্ত সরকার ব্যবস্থা ও প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় শর্ত হচ্ছে, সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। আর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হচ্ছে মানুষের কথা বলা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা। এর আগে এ ক্ষেত্রে কিছু আইনি বাধার সৃষ্টি হয়েছে। এই বাধাগুলো সরকারকে দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
মানুষ বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে মহাজোটের পক্ষে বিপুল রায় দিয়েছে। নানা শ্রেণির, নানা মানুষের অসংখ্য প্রত্যাশা। কোনোটি ছোট, কোনোটি বড়। নতুন সরকারের সামনে সেই প্রত্যাশা পূরণই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়টি আরও বিশ্নেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি মানুষের যে বিপুল আস্থার প্রতিফলন নির্বাচনের ফলে দেখা গেছে, সে আস্থার প্রতিদান দেওয়াটাই এখন নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, বড় জয় প্রকৃতপক্ষে নতুন সরকারের সামনে বড় দায়িত্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে এবারের নির্বাচনের ফলে সংসদে যেহেতু বিরোধী দলের অংশটি খুবই ক্ষুদ্র, সে কারণে সরকারকেই সংসদ পরিচালনায় জবাবদিহি এবং ভারসাম্য নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হতে হবে। অর্থাৎ জনগণের সামনে সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে, সংসদে জনপ্রত্যাশার কথা আলোচিত হচ্ছে, জনগণের যেসব বিষয়ে প্রশ্ন আছে সেগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে গত দশ বছরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ও বিস্তৃতি সফলভাবে এগিয়ে নেওয়াটাও আর একটা চ্যালেঞ্জ। দেশের সব মানুষের কাছেই উন্নয়নের সুফল যেন পৌঁছে যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, গত দশ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করেছেন এবং দৃশ্যমান করেছেন। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রাখা যায় যে. এবারও তিনি মানুষের বিপুল আস্থার প্রতিদান সফলভাবেই দেবেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জকে দেখছেন একটু ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা। সমঝোতা, সহিষ্ণুতা এবং পরমত শ্রদ্ধার নতুন রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, অন্তর্ভুক্তি ও সমতা নিশ্চিত করা হবে। যদি অন্তর্ভুক্তি ও সমতা নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে নতুন ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। তিনি বলেন, নতুন ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি থেকে মৌলবাদী শক্তি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। জামায়াত নিষিদ্ধ না হলে রাজনীতিতে মৌলবাদের বিষবাষ্প দূর হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বদিউল আলম আরও বলেন, নতুন সরকারকে জনপ্রত্যাশা পূরণে শুরুতেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আর এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হলে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ই অতীতে নানা অনিয়মের দায়ে বিতর্কিত চরিত্রগুলো বাদ দিতে হবে। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে দক্ষতার পাশাপাশি সততার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে সফল হতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। দুর্নীতির অনুসন্ধানে গণমাধ্যমের সামনে কোনো আইনি বা প্রশাসনিক বাধা রাখা যাবে না বলে তিনি মনে করেন। 
