পাবনার দুগ্ধ খামারিরা করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিপাকে পড়েছেন । হোটেল ও চায়ের দোকান বন্ধ । সাধারণ মানুষও দুধ কিনছেন না । ফলে পানির দামেও দুধ বিক্রি করতে পারছেন না খামারিরা। এদিকে গো-খাদ্যের দামও বেড়েছে। ভাবনায় এখন খামারিরা।
পাবনার টেবুনিয়ায় দাশুরিয়া খ্রিস্টানপাড়ার খামারি আনসার মিয়া বিক্রির জন্য ৩০ লিটার দুধ তুলেছেন। বেলা ১১টা থেকে দুপর একটা পর্যন্ত কোনো পাইকার দুধের দাম পর্যন্ত করেন নি। একই অবস্থা বাজারে বিক্রির জন্য আসা অন্তত ২শতাধিক বিক্রেতার। শুক্রবার টেবুনিয়া দুধ বাজারে এই চিত্র দেখা যায়। এখানকার অন্তত ২০জন বিক্রেতা দুধবাজারে করোনা ভাইরাসের প্রভাবের কথা বললেন। শহরের দইবাজার মোড়ের দই বিক্রেতা কালা চাঁদ ঘোষ বললেন, শহরের তিনটি মিষ্টির দোকানে তার তৈরি দই-মিষ্টি সরবরাহ করা হতো। করোনা ভাইরাসের কারণে সপ্তাহখানেক কারখানা বন্ধ রেখেছেন। শহরের হামিদ রোডের এক মিষ্টি ব্যবসায়ী বললেন, তার হোটেলে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ আসছেন না।
পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর উপজেলা দেশের অন্যতম প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে বিবেচিত। পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, পাবনা অঞ্চলে গো-খামারির সংখ্যা ৬ হাজারের ওপর। প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ লাখ লিটার তরল দুধ উৎপন্ন হয়। যার প্রায় অর্ধেক মিল্কভিটা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ করে। এই শিল্প গড়েই উঠেছে মিল্কভিটা ও অন্যান্য দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। এ এলাকার প্রায় পাঁচ শতাধিক গ্রামের হাজার হাজার পরিবার ভালো লাভ পাওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে দুগ্ধজাত গাভী পালন করেন। এখানে প্রচুর দুধ উৎপাদিত হওয়ায় এ এলাকা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং দুধ, প্রাণ ডেইরি, ফার্মফ্রেশ, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরিসহ কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে খোলাবাজারে বিক্রি করে থাকে। কিন্তু এখন করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দুধের চাহিদা পড়ে যাওয়ায় খামারিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।
বেড়ার জোড়দহ-বাঙ্গাবাড়িয়া প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতির (মিল্কভিটা) সভাপতি জানান, তার সমিতিতে অর্ধ শতাধিক খামারি রয়েছেন। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার আগে সমিতির সদস্যরা সকাল-বিকেল মিলিয়ে মিল্ক ভিটায় ৬শ লিটারের বেশি দুধ দিতেন। প্রতি লিটার ৪০ থেকে ৪২ টাকা দরে। এখন সেখানে মিল্ক ভিটার কাছে তাদের ১৫০ লিটার দুধ বেচাই কঠিন। বাকি দুধ খোলাবাজারে ১৫ থেকে ১৬ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছেন। কখনো কখনো এই দামেও দুধ নেওয়ার ক্রেতা পাচ্ছেন না তারা।
সাঁথিয়ার এক খামারি বললেন, এখন করোনাভাইরাসের প্রভাবে দুধের চাহিদা একেবারেই পড়ে যাওয়ায় খামারিরা পানির দরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। গো খাদ্য কেনা আর দুধ বিক্রি হিসাব করলে ঘরের পুঁজি চলে যাচ্ছে। তবে অনেক খামারিই এখন দুধ থেকে ননি তুলে রেখে ক্ষতি কিছুটা কমাচ্ছেন।
জেলার ফরিদপুর উপজেলার দুগ্ধখামার মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম শুক্রবার জানান, তার খামারে গরুর সংখ্যা ৭০। প্রতি সপ্তাহে ২৮ হাজার টাকার খাদ্য লাগে। তিলের খইল এই দুর্যোগের আগে কিনলেন, ২২০০ টাকা বস্তাা (৫০ কেজি)। সেই খইল এই সপ্তাহে কিনছেন ৩২০০ টাকা। গম ভুসিসহ সব ধরনের গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে। ৮২০টাকা (৩৭কেজি)র গমভুষির বস্তা এখন ১৩২০টাকা। মিল্কভিটা আগে সকাল-বিকাল দুধ নিত। কিন্তু এখন শুধু বিকালে নিচ্ছে। স্থানীয় খুচরা বাজারে প্রতি লিটার তরল দুধের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা।তিনি বলেন, ‘গরুর খাদ্যের দাম কয়েক দিনে বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই আমরা ভাল নেই। এর ওপর দুধ বিক্রির জায়গা নাই। এ অবস্থা চলতে থাকলে খামারিরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে । করোনা নামের রোগে পথের ফকির হয়ে যাচ্ছি আমরা।’
তিনি আরও বললেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই খামারিদের দুধ বিক্রির প্রধান জায়গা। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ নেওয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান এই সুযোগে কম দামে দুধ কেনার চেষ্টা করছে। তা–ও তাঁদের তালিকাভুক্ত খামারি ছাড়া অন্যরা সেখানেও বেচতে পারছেন না। লোকজন ঢাকা শহর ছাড়ায় সেখানে দুধ প্রায় চলছেই না। পাবনার বেশির ভাগ ছানা, ঘি ও মিষ্টি তৈরির কারখানা বন্ধ।
তবে মিল্ক ভিটার বাঘাবাড়ি কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক ইদ্রিস আলীর দাবি, তাঁরা দুধ সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছেন। আর প্রাণের প্রধান ডেইরি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাকিবুর রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরা দুধ সংগ্রহ না কমিয়ে বরং বাড়িয়েছেন।বাড়তি দুধ গুঁড়া দুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, কম নয়, আগের দামই দেয়া হচ্ছে।
শুক্রবার সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলা গ্রামের একটি ছানা ও ননি তৈরির কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে খামারিরা দুধ বিক্রি করতে এসেছেন। কারখানার মালিক ওয়াজেদ আলী ২০ টাকা লিটার দরে ৬০০ লিটার দুধ সংগ্রহ করে রাখার পর বাকি দুধ ফিরিয়ে দেন। ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘ যতটুকু পারছি দুধ নিয়ে তা থেকে ননি তুলে ফেলছি। আগে ননিবিহীন দুধ ১০ থেকে ১৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি হতো। এখন বিনা পয়সায় নেওয়ারও কেউ নাই, ফেলে দিতে হচ্ছে।’
ওই কারখানায় দুধ দিতে না পেরে এক খামারি হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় বলেন, ‘এই জায়গায় তা-ও প্রতি লিটারের দাম ২০ টাকা পাওয়া যায়। বাজারে নিলে ১৫ টাকা পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।’

